
সেমিকন্ডাকটর, ত্রিযোজী, পঞ্চযোজী মৌল এবং ডোপিংঃ
ইলেকট্রন পরমাণু গঠনকারী মৌলিক কণা যা নিউক্লিয়াসের বাইরে শক্তিস্তরে অবস্থান করে। রাসায়নিক বন্ধন গঠনের সময় বিভিন্ন পরমানুর মধ্যে ইলেকট্রনের আদান-প্রদান এবং ইলেকট্রন জোড় শেয়ারিং হয়ে থাকে। যেসব মৌলের পরমাণুর বহিঃস্থ শক্তিস্তরে তিনটি ইলেকট্রন থাকে, তাদের ত্রিযোজী; চারটি থাকলে চতুর্যোজী এবং পাঁচটি থাকলে পঞ্চযোজী মৌল বলে।
উল্লেখ্য, বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাকটর (সিলিকন, জার্মেনিয়াম) চতুর্যোজী। এদেরকে পঞ্চযোজী কিংবা ত্রিযোজী পরমানু দ্বারা "ডোপিং" করে সেমিকন্ডাক্টরের পরিবাহিতা বৃদ্ধি করা হয়।
পি-টাইপ, এন-টাইপ সেমিকন্ডাকটরঃ
n - টাইপ অর্ধপরিবাহীতে ডোপিং করা হয় পঞ্চযোজী মৌল দ্বারা (যেমনঃ আর্সেনিক)। এর ফলে, পঞ্চযোজী পরমানুগুলো চারটি অর্ধপরিবাহী পরমাণুর সাথে বন্ধন তৈরি করার পরেও তাদের একট করে ইলেকট্রন অবশিষ্ট থাকে। এই অবশিষ্ট ইলেকট্রনটি n টাইপ অর্ধপরিবাহীর পরিবাহিতা বাড়ায়।
p টাইপ অর্ধপরিবাহীতে ডোপিং করা হয় ত্রিযোজী মৌল দ্বারা (যেমনঃ বোরন)। এর ফলে সেমিকন্ডাকটরে প্রতিটি ত্রিযোজী মৌলের জন্য একটি করে "হোল" সৃষ্টি হয়, যা সেমিকন্ডাক্টরের পরিবাহিতা বাড়ায়।
হোল এবং পজিটিভ চার্জ ক্যারিয়ারঃ
সেমিকন্ডাকটরের কেলাসের মধ্যে যখন কিছু ত্রিযোজী মৌল ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তখন সেগুলো সেমিকন্ডাকটরের কেলাসের মধ্যে নিজের জায়গা করে নেয়। অর্থাৎ, সেমিকন্ডাকটরের একটি পরমাণু যেমন আরো চারটি পরমাণুর সাথে সমযোজী বন্ধন গঠন করে, ত্রিযোজী মৌলের পরমাণুও সেই কাজটিই করে। সমস্যা হচ্ছে, চারটি সমযোজী বন্ধন তৈরি করতে বহিঃস্থ কক্ষপথে চারটি ইলেকট্রনের প্রয়োজন, কিন্তু তার আছে মাত্র তিনটি।
এর ফলে এক মজার ঘটনা দেখা দেয়। চতুর্থ বন্ধনে একটি ইলেকট্রনের ঘাটতি পূরণের জন্য অন্য একটি সেমিকন্ডারকটর পরমাণু থেকে একটি ইলেকট্রন চলে আসে, যার ফলে ঐ সেমিকন্ডাকটর পরমাণু বন্ধন তৈরির সময় ইলেকট্রনের ঘাটতি অনুভব করে। সেই ঘাটতি পূরণের জন্য আবার একটি ইলেকট্রন আসে অপর কোন পরমাণু থেকে। চাইলে এটাকে "ইলেকট্রনের শুণ্যতা এক পরমাণু থেকে অন্য পরমাণুতে ঘুরে বেড়াচ্ছে" এভাবেও চিন্তা করা যায়।
এই যে ইলেকট্রনের ঘাটতি, কিংবা শূন্যস্থান - একেই বলে "হোল"। সেমিকন্ডাকটরে পঞ্চযোজী মৌলের পঞ্চম ইলেকট্রনটি যেমন পরিবাহিতা বাড়ায়, ত্রিযোজী মৌলের ইলেকট্রন শূন্যতাও পরিবাহিতা বাড়ায়। ইলেকট্রন ঋণাত্মক চার্জযুক্ত, ইলেকট্রনের শূন্যতা (হোল) ধনাত্নক চার্জযুক্ত। শুধুমাত্র হোল বিশিষ্ট সেমিকন্ডাকটর পদার্থেই আমরা ধনাত্মক চার্জের প্রবাহ দেখতে পাই।
ইলেকট্রন এবং হোল
ধরুন আপনি আপনার বাসা থেকে ভার্সিটিতে যাতায়াতের জন্য বাস ব্যবহার করেন। একদিন সকালে ক্লাসে যাওয়ার সময় বাসে উঠলেন কিন্তু বাসে শুধুমাত্র ১টি সিটই খালি আছে এবং তা সবার পেছনের সারিতে। তাই বাধ্য হয়ে আপনি গিয়ে সেখানেই বসে পড়লেন। কিছুদূর যাওয়ার পর আপনার সামনের সারির একজন উঠে গেল। ফলে তার সিটটি ফাকা হয়ে গেল এবং আপনি আপনার সিট থেকে উঠে সেখানে চলে গেলেন। নেক্সট স্টপেজে আপনার বর্তমান সিটের সামনের সারির একজন নেমে গেলো, আবার আপনি উঠে সেখানে গিয়ে বসলেন। এভাবে কিছুক্ষণ পর পর আপনার সামনের একটি করে সিট খালি হতে থাকলো এবং আপনিও এক সারি করে সামনে অগ্রসর হতে থাকলেন। তারপর ভার্সিটি তে পৌছে দেখা গেলো আপনি একদম সামনের সারির সিটে বসে আছেন।
কি ভাবছেন, ভোল্টেজ ল্যাব আবার গল্প লেখা শুরু করলো কবে থেকে তাইতো? কিন্তু আমদের প্রাত্যাহিক জীবনের এই গল্পটির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে ইলেকট্রন এবং হোলের কাহিনী।
ইলেকট্রন এবং হোল হল এক ধরণের চার্জ ক্যারিয়ার যাদের জন্য এক্সট্রিন্সিক বা ভেজাল মিশ্রিত সেমিকন্ডাক্টরে আধান প্রবাহিত হয়। হোল হল মূলত ইলেকট্রনের শূণ্যতা বা ইলেকট্রনের অনুপস্থিতি এবং বাস্তবে হোলের কোন অস্তিত্ব নেই, এটি শুধুমাত্র একটি ধারণা। উপরের গল্প অনুসারে আপনি নিজেকে একটি ইলেকট্রন হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন।
আপনি যখনই একটি সিট ছেড়ে সামনে অগ্রসর হয়েছেন, তখনই আগের সিটটি খালি হয়ে গিয়েছিল এবং ইলেকট্রনিক্সের ভাষায় একে বলা হয় হোল। বাস্তবিক ইলেকট্রন গুলোও ঠিক একই আচরণ করে, তারা যখনই একটি পরমাণু থেকে অন্য পরমাণুতে গমন করে তখনই সেখানে একটি হোলের সৃষ্টি হয়। তারপর অন্য একটি ইলেকট্রন সেই হোলে আগমন করে এবং এক সময় সেও ছেড়ে চলে যায়। মূলত ইলেকট্রন স্থায়ী ভাবে কোন পরমাণুতে অবস্থান করে না। ইলেকট্রন গতিশীল তাই হোলও গতিশীল। ইলেকট্রন এবং হোল সবসময় পরস্পরের বিপরীত দিকে চলে।
ইলেকট্রন ঋণাত্বক আধানযুক্ত তাই হোলকে ধনাত্বক আধানযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইলেকট্রন এবং হোল মূলত সেমিকন্ডাক্টরে বিদ্যুৎ পরিবাহী হিসেবে কাজ করে। হোল যেদিকে প্রবাহিত হয়, কারেন্ট ঠিক একই দিকে প্রবাহিত হয়। আর ইলেকট্রন তার বিপরীত দিকে। পি টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে তড়িৎ প্রবাহ ঘটে প্রধানত ধনাত্মক আধান বা হোলের দরুন। তাই এখানে হোল হল গরিষ্ঠ আধান বাহক এবং ধনাত্মক আধান বা ইলেকট্রন হলো লঘিষ্ঠ আধান বাহক। অপরদিকে এন টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে গরিষ্ঠ বাহক হলো ইলেকট্রন এবং লঘিষ্ঠ বাহক হলো হোল।
0 Comments